ঢাকা উত্তরের প্রশাসক এজাজের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু
নিজস্ব প্রতিবেদক
নভেম্বর ২৯, ২০২৫, ০১:৪৭
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) বর্তমান প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজের বিরুদ্ধে ওঠা ‘অবৈধ সুবিধা গ্রহণ, ক্ষমতার অপব্যবহার ও আর্থিক অনিয়ম’-সংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
বৃহস্পতিবার দুদকের অভিযোগ সেল থেকে জারি করা এক আদেশে তদন্ত প্রক্রিয়া শুরুর বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। এই নির্দেশনার মাধ্যমে প্রথমবারের মতো ডিএনসিসির শীর্ষ দায়িত্বে থাকা একজন প্রশাসকের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অনুসন্ধান প্রক্রিয়া শুরু হলো যা নগর প্রশাসনে বড় ধরনের আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
দুদকের চিঠিতে কী বলা হয়েছে অভিযোগ সেল থেকে পাঠানো চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রশাসক এজাজের বিরুদ্ধে জনমানুষের পাঠানো অভিযোগগুলো প্রাথমিকভাবে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। কমিশনের বৈঠকে বিষয়টি আলোচনার পর তদন্ত–১ দপ্তরকে প্রয়োজনীয় আনুষঙ্গিক তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই-বাছাইয়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অভিযোগগুলোতে মূলত— হাট–বাজার ইজারা বাতিলের ক্ষেত্রে অনিয়ম, সরকারি রাজস্ব ক্ষতির সম্ভাবনা তৈরি, টেন্ডার প্রক্রিয়া ‘অস্বচ্ছ’ভাবে পরিচালনা, এবং প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ—এসব বিষয় উঠে এসেছে। দুদক সূত্র বলছে, তদন্ত কর্মকর্তারা ডিএনসিসি এবং সংশ্লিষ্ট সরকারী দপ্তর থেকে ইতোমধ্যে বেশ কিছু নথি সংগ্রহ করেছেন। প্রয়োজনে সরাসরি সাক্ষাৎকারও নেওয়া হবে।
অভিযোগ স্বাগত জানিয়ে প্রশাসক এজাজের প্রতিক্রিয়া অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রশাসক এজাজ জানিয়েছেন, তিনি তদন্তে খোলামেলা সহায়তা করবেন এবং যেকোনো ধরনের তথ্য দিতে প্রস্তুত আছেন।
তার ভাষায়, আমরা সবসময় স্বচ্ছভাবে কাজ করেছি। অভিযোগ উঠলে তদন্ত হোক—এটাই সবচেয়ে ভালো উপায়। জনগণের টাকায় পরিচালিত দায়িত্বে দায়বদ্ধতা থাকা জরুরি। দুদকের তদন্ত কর্মসূচিকে আমরা স্বাগত জানাই। নগর উন্নয়নসংক্রান্ত বিভিন্ন সিদ্ধান্ত, বিশেষ করে ইজারা বাতিল এবং ‘খাস আদায়’ নীতিমালা নিয়ে তার নেওয়া কয়েকটি সিদ্ধান্ত গত কিছু মাস ধরে আলোচনায় ছিল। গাবতলী হাট ইজারায় অনিয়মের অভিযোগই তদন্তের কেন্দ্রবিন্দু ডিএনসিসির একটি আলোচিত সিদ্ধান্ত হলো—২০২৫ সালের গাবতলী গবাদিপশুর হাটের ইজারা বাতিল। যেখানে সর্বোচ্চ দরদাতা প্রায় ২২ কোটি টাকার প্রস্তাব জমা দিয়েছিলেন। অথচ সরকার নির্ধারিত দরের তুলনায় বহুলাংশে বেশি দরের এই ইজারা সামান্য যুক্তিতে বাতিল করে ‘খাস আদায়’ পদ্ধতিতে হাট পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
পরবর্তীতে দুদক তদন্ত করে জানায়— হাট ইজারার ক্ষেত্রে বিপিপিএ ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই, অথচ এ যুক্তি দেখিয়ে ইজারা বাতিল করা হয়েছে, এবং সরকারের সম্ভাব্য বড় অঙ্কের রাজস্ব আয় কমে যাওয়ার বাস্তব ঝুঁকি ছিল। এসব কারণেই চলতি বছরের এপ্রিল মাসে দুদক ডিএনসিসি কার্যালয়ে সরেজমিনে অভিযান চালায়। সেই অভিযান থেকেই ধীরে ধীরে অভিযোগ অনুসন্ধানের পথ তৈরি হয়। প্রশাসক এজাজের নিয়োগ–রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ২০২৪ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর দেশব্যাপী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় বড় ধরনের রদবদল আসে। আগস্টে ১২টি সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত মেয়রদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এই পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজকে এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক প্রশাসক করা হয়। ডিএনসিসির নির্বাচিত মেয়র আতিকুল ইসলাম সেই সময় জনপরিসরে অনুপস্থিত ছিলেন। পরে তাকে গ্রেফতারও করা হয়। সেই পরিস্থিতিতে প্রশাসক হিসেবে এজাজ দায়িত্ব নেন এবং বিভিন্ন উন্নয়ন ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত হাতে নেন।
শহরজুড়ে আলোচনা: প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নাকি অসঙ্গত প্রভাব? নগরবাসীর একাংশ মনে করেন, ডিএনসিসি পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রশাসক কঠোরতার সঙ্গে কাজ করেছেন। তবে অন্যরা বলছেন—কিছু সিদ্ধান্ত স্বচ্ছতার অভাবে বিতর্ক তৈরি করেছে। বিশেষ করে হাট ইজারা ও নগর রাজস্ব ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে বিশেষজ্ঞদের ভিন্নমত রয়েছে।
নগর পরিকল্পনা–বিশেষজ্ঞরা মনে করেন— সিটি করপোরেশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে যেকোনো সিদ্ধান্তই হতে হবে স্বচ্ছ, কাগজপত্রভিত্তিক ও নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অভিযোগ ওঠা মানেই দায় প্রমাণ নয়; তবে তদন্ত হলে সত্য সামনে আসবে। দুদকের আগের অভিজ্ঞতা ও ভবিষ্যৎ ধাপ ডিএনসিসি–সংক্রান্ত অভিযোগ তদন্তে দুদকের দল সাধারণত— ১) নথি সংগ্রহ, ২) সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য নেওয়া, ৩) আর্থিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রমের তুলনামূলক বিশ্লেষণ, ৪) এবং আইনি অবস্থান যাচাই—এসব ধাপ অনুসরণ করে।
প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে কমিশন যদি মনে করে, অভিযোগের পর্যাপ্ত ভিত্তি রয়েছে—তাহলে আনুষ্ঠানিক মামলা বা পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শুরু করা হবে। দুদক কর্মকর্তারা বলছেন—অভিযোগের প্রকৃতি গুরুতর। দ্রুত ও নিরপেক্ষ অনুসন্ধানের মাধ্যমে সত্য উদঘাটনই আমাদের লক্ষ্য।
স্বচ্ছ তদন্তের দাবি নাগরিক সমাজের নগর উন্নয়ন বিষয়ক নাগরিক সংগঠনগুলো জানিয়েছে, যেকোনো হাই–প্রোফাইল অভিযোগই জনস্বার্থের সঙ্গে জড়িত। তাই তদন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্পন্ন হওয়া জরুরি। তারা বলছেন— ডিএনসিসি রাজধানীর অর্ধেকের বেশি জনগণকে সেবা দেয়। এখানে অনিয়ম থাকলে তার প্রভাব সরাসরি নগরবাসীর ওপর পড়ে। তাই তদন্তের ফলাফল প্রকাশ্য করার দাবি রয়েছে।
প্রশাসক এজাজের বিরুদ্ধে দুদকের এই অনুসন্ধান রাজধানীর নগর প্রশাসন, সরকারি ব্যবস্থাপনা এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর নতুন ক্ষমতার কাঠামো—সব কিছুতেই নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অভিযোগ সত্য বা মিথ্যা—দুদকের তদন্তই এখন সঠিক চিত্র নির্ধারণ করবে। আর প্রশাসকের ভাষায়— স্বচ্ছ তদন্তই প্রকৃত সত্যকে সামনে আনতে পারে।
আমার সংবাদের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন